শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড- এই সংকোচিত বাক্যের ভাব-সম্প্রসারনের চেতনাকে স্বীকৃতির ফল স্বরুপ শিক্ষা ব্যবস্থার ভারে নুয়ে পড়া মেরুদন্ড নিয়ে জাতি আজ হামাগুড়িতে ব্যস্ত। বিশেষ করে গত দশ বারো বছরে পাশের হার যা প্রায় গড়ে ৭৮% আর অগুনিত A+ (প্রত্যেক বিষয়ে গড়ে ৮০)এর ভিড়ে A গ্রেড প্রাপ্তদের তো সমাজে মুখ দেখানোরই অধিকার নেই।এই সমাজ চিত্র দেখলে যে কোনো ব্যক্তির পিলে চমকে যাবে। আরে এতো শিক্ষিত জনতার হাত ধরেই তো দেশ এগিয়ে যাবে। তা বেশ দেশ এগিয়ে যাক..
কিন্তু যখন আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি এর ইংরেজি শুনতে হয় I am gpa 5 তখন আরও একবার পিলে চমকে যায়। গত কয়েক বছরের হাস্যকর শিক্ষা প্রহসন ছাড়িয়েছে বিগত সব রেকর্ড। সারা বছর ঘুরে ফিরে পরীক্ষার আগের রাতে ফেসবুকে ঢু মারলেই প্রশ্ন রেডি। সারারাত সেগুলো পড়ে সকালে পরীক্ষা দিলেই ফলাফল যথারীতি আই আম জিপিএ 5।
এছাড়াও আমি ব্যক্তিগত একটা উদাহরনের স্বীকার।একটা ভাইবা বোর্ডে একজন ইংরেজিতে অনার্স পড়ুয়া ছাত্রকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, flower ও flour এর পার্থক্য কি? উত্তর ছিল flower ফুল আর flour বলতে ডিকশনারীতে কোনো শব্দ নেই।
তা বেশ বাদ দিলাম ইংরেজির কথা, ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা নয় তাই ইংরেজি না জানলেও চলবে। এবার আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় আসা যাক। এদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ধারী(এম,এ)অনেকেই আছেন যাদের বাংলা বানান পড়লে মনে হয় যুক্ত বর্ণ, রেফ এগুলো বুঝি বিলুপ্ত হয়ে গেছো। আসলে ছাত্র-ছাত্রীদের দোষ দিয়ে কি লাভ। আপনি যদি একগ্লাস পানিতে একটু গনিত, একটু বাংলা, ইংরেজি, ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান সহ তেরোটি বিষয়ের মিশ্রণ ঘটান তবে সেখানে বিস্ফোরন ঘটবে এটাই তো স্বাভাবিক।
আমাদের ছোটবেলা থেকেই ছড়া পড়ানো হয়
হাট্টিম আ টিম টিম,তারা মাঠে পাড়ে ডিম।
না নিয়ে গেলো বোয়াল মাছে,তাই না দেখে ভোঁদর নাচে। আর একটু বড় হলে ভুত প্রেতের যত কিচ্ছা কাহিনী কিন্তু বাস্তবে আমরা না দেখি ভোঁদরের নাচ বা হাট্টিম আ টিমের অস্তিত্ব। তাই মিথ্যা ছড়া দিয়েই পড়াশুনার শুরু। তারপর ফররুখ আহমেদ ও কায়কোবাদের ছড়া,কবিতা। এরপর সেই যুগযুগান্তর ধরে চলে আসা কবিতা ও উপন্যাস গুলোই চলে আসছে। যেখানে সাধু ভাষা এখন যাদুঘরে রাখার সময় এসেছে সেখানে হৈমন্তী, বিলাসী এখনও পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত। যৌতুকের বলি গৃহবধু বা মিষ্টি প্রেমের ছোঁয়া ছুঁই বর্তমান বাস্তব প্রেক্ষাপটে কতটুকু গ্রহনযোগ্য তা এ অধমের বোধোগম্য নয়।
মনে হয় যেনো আটচল্লিশ বছরে এ দেশে কোনো কবি সাহিত্যিকের জন্মই হয়নি। রুদ্র, হেলাল হাফিজ, জয় গোস্বামী, নির্মলেন্দ গুন,হুমায়ুন আহমেদ,জাফর ইকবাল,আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আজাদ, সেলিনা হোসেন আসলে এরা যা লিখছেন তা দিয়ে মনে হয় শিক্ষামন্ত্রনালয় যৌনতার গন্ধ পান কিন্তু দৈহিক শিক্ষার নামে বিজ্ঞ শিক্ষক সাহেব যখন রসিয়ে রসিয়ে ঋতুস্রাব কি ও তার লক্ষণ ব্যাখ্যা করেন আর ছাত্রীরা মিটি মিটি হাসেন তার মধ্যে যৌনতা থাকে না, থাকে সচেতনতার দীক্ষা। বড় বিচিত্র আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
এরপরে আসা যাক অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সালোকসংশ্লেষন, জীব জড়ের পার্থক্য, অনু পরমানু, উত্তল অবতল লেন্স, বিজ্ঞানের এসব টোটকা জ্ঞান নেয়া ছাত্র-ছাত্রীকে নবম দশম শ্রেণিতে পুরো দস্তুর বৈজ্ঞানিক বানানোর লক্ষে পদার্থ, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান, উচ্চতর গনিত নামের চারখানা বিজ্ঞান বিষয়ক বই ধরিয়ে দেয়া হয়।যেখানে রাদারফোর্ডের অপ ব্যাখ্যা কে খন্ডাইছে, হাজার দুই বৈজ্ঞানিক নাম,
ক্যামিকেল রিয়াকশন, জীব জগৎ, উদ্ভিদ জগৎ, পীথাগোরাসের উপপাদ্য খায় না মাথায় দেয় বুঝতে বুঝতেই দুবছর শেষ,পরীক্ষা শুরু।
আর এক গ্রুপ হচ্ছে কমার্স যাদের ধারনাই দেয়া হয় বড় হলেই তাদের জন্য ব্যাংকার হওয়া ঠেকায় কে।আর যদি তুমি আর্টস নেও ধরেই নেয়া হয় তুমি গবেট কিসিমের ছাত্র অতএব তোমাকে মুখস্ত করে যেতে হবে রাষ্ট্র বিজ্ঞান একটা গতিশীল বিজ্ঞান।এ্যারিস্টটাল এর জনক, এছাড়া তোমার কোনো গতি এদেশে নাই।
বেশ এস,এস,সি পুরোনো উপায়ে নিশ্চিত A+।
কলেজে প্রবেশ করে নিজের পরিবর্তন বুঝে উঠতেই ৩/৪ মাস চলে যায়। তারপর ১ম বর্ষে ছখানা ও ২য় বর্ষে ছখানা পিড়ামিড সম বই। আবার ২য় বর্ষ শেষ হলে দুবর্ষ মিলিয়ে ১২ খানা পরীক্ষা দিয়ে তবে নিস্তার। পড়বি না যাবি কই!
পাশ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলেও সমস্যা নেই আছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী কোচিং সেন্টার। সেখানে সেমিস্টার সিস্টেমে আর এক প্রহসন। ৪ মাসে এক সেমিস্টার ৪টি করে ৪০০ পাতা সম্বলিত বই। মোটামুটি ৪বছরে গোটা পঞ্চাশেক নামকরা প্রফেসর, বিজ্ঞানী বা আইনজীবীদের ইংরেজিতে লেখা বই শেষ। পড়ায় না পৃষ্ঠা উল্টায় তা সবার ভালোই জানা। সারা জীবন ইংরেজি থেকে পলাতক আসামী ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে শোনে ইংরেজি লেকচার। তারপর টার্মপেপার, এ্যাসাইনমেন্ট এসব তো আছেই। তারপরও সমস্যা নেই টাকা পয়সা ঠিকমত পরিশোধ করলে মাথায় কালো ক্যাপ হাতে সার্টিফিকেট নিয়ে তুমিও একদিন একটা লাফ দিতে পারবে।
এবার চাকরী বাজারে প্রবেশ, বায়োডাটা নিয়ে ঘুরতে থাকো, চার পাঁচ জোরা জুতোর শুকতলি শেষ হোক তারপর দেখা যাক কি হয়! যদি মামুর জোর চাচার জোরে চাকরী হয়েও যায় তবে ভুলে যাও এতোদিন যা শিখে এসেছো। তোমার সিনিয়র যা বলবেন সেটাই এখানে আইন।
এমনকি যা চিরন্তন সত্য জেনে এসেছো সেখানেও উল্টে যাবে,মএই যেমন ধরো…
অর্থই সকল অনর্থের মূল হয়ে যাবে অর্থই সকল সুখের মূল।
সততাই উৎকৃষ্ট নীতি হয়ে যাবে বেঈমানীই পকেট ভরার একমাত্র পন্থা।
শিক্ষা জ্ঞান অর্জনের জন্য। তথাকথিত ভুল শিক্ষা ব্যবস্থার তথাকথিত সার্টিফিকেটের জন্য নয়। এ শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষ নয় চাকর তৈরী করে।
আসাদ জামান
কবি ও কলামিস্ট।